
বিশ্বজুড়ে এখন নতুন আতঙ্কের নাম জিকা ভাইরাস। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার মতো জিকাও ছড়ায় এডিস মশার মাধ্যমে। দেশে প্রথমবারের মতো জিকা ভাইরাসের ক্লাস্টার শনাক্ত হয়েছে। ক্লাস্টার সংক্রমণের বিষয়ে আই.সি.ডি.ডি.আর.বি.-এর গবেষকরা ২০২৩ সালে জ্বরে আক্রান্ত ১৫২ জন রোগীর জিকার লক্ষণ রয়েছে এমন সন্দেহে তাদের নমুনা পি.সি.আর. ভিত্তিক পরীক্ষা করা হয়। এতে পাঁচজনের নমুনায় জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া যায়। ২০২৪ সালে আই.ই.ডি.সি.আর.-এর তথ্য অনুযায়ী তিন মাসে আটজনের শরীরে এ ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের বাড়িতে পাওয়া মশার নমুনাতেও জিকা ভাইরাস পাওয়া গেছে। তারা সবাই ঢাকার বাসিন্দা। সম্প্রতি চট্টগ্রামে দুই ব্যক্তির শরীরে জিকা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে।
* ইতিহাস
‘জিকা’ নামটি নেওয়া হয়েছে উগান্ডার ‘জিকা’ বন থেকে। ১৯৪৭ সালে জ্বর নিয়ে গবেষণার জন্য বিজ্ঞানীরা জিকা বনে একটি বানরকে খাঁচায় আটকে রাখে। ১৯৪৮ সালেও গবেষণার জন্য আরেকটি বানরকে আটকে রাখে। পরে বানরগুলো জ্বরে আক্রান্ত হলে তাদের দেহে একটি সংক্রামক এজেন্টের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়। ১৯৫২ সালে এর নাম দেওয়া হয় ‘জিকা ভাইরাস’। এরপর ১৯৫৪ সালে নাইজেরিয়ায় এক মানুষের দেহে এ ভাইরাস পাওয়া যায়। ১৯৫১ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এ ভাইরাস সংক্রমণের তথ্য পাওয়া যায়। ২০০৭ সালে প্রথম বড় ধরনের প্রাদুর্ভাব পরিলক্ষিত হয় মাইক্রোনেশিয়ার ইয়াপ দ্বীপে। এখন পর্যন্ত জিকা ভাইরাসে সবচেয়ে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েছে ব্রাজিলের কিছু কিছু এলাকায়। ব্রাজিলের পর সবচেয়ে বেশি সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে কলম্বিয়াতে। এরপর ধীরে ধীরে সংক্রমণের খবর আসে ইকুয়েডর, এল সালভেদর, জামাইকা ও পুয়ের্তো রিকোতে। পরবর্তীকালে রোগটি আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশেও ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকাতেও ছড়িয়ে পড়ে সংক্রমণের ঘটনা। সেখানে ভাইরাসে আক্রান্ত কয়েক ডজন রোগী শনাক্ত করা হয়।
* ধরন
ইয়েলো ফিভার, ওয়েস্ট নাইল, চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু যে গোত্রের সদস্য, জিকা ভাইরাসও একই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত একটি ফ্লাভিভাইরাস।
* কীভাবে ছড়ায়
এটি ভাইরাসবাহিত এডিস মশার কামড়ে হয়। সাধারণত দিনের বেলায় সুস্থ ব্যক্তিকে মশার কামরের মাধ্যমে ভাইরাসটি মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে এবং তখন ওই ব্যক্তি আক্রান্ত হয়। আবার ওই ব্যক্তিকে অন্য এডিস মশা কামড়ালে, সেই মশার মধ্যে ভাইরাস প্রবেশ করে এবং অসুস্থ মশাটিও অন্য সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ালে সেও আক্রান্ত হয়। এভাবেই ভাইরাসটি মশার কামড়ের মাধ্যমে মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে বিস্তার ঘটায়। তবে সরাসরি মানুষ থেকে মানুষের সংস্পর্শে এ ভাইরাস ছড়ায় না। এ ছাড়াও মানুষের শুক্রাণুতে এ ভাইরাসের উপস্থিতি লক্ষ করা যায় বিধায় অরক্ষিত যৌন সম্পর্কের মাধ্যমেও এ ভাইরাস ছড়াতে পারে। রক্ত সংক্রমণ এবং গর্ভাবস্থায় মা থেকে গর্ভস্থ শিশুর শরীরে এ ভাইরাস সংক্রমিত হতে পারে।
* লক্ষণ
যে কোনো বয়সের লোক এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। জিকার লক্ষণ ডেঙ্গুর মতোই। তবে জিকা ভাইরাসের ৮০ শতাংশের সংক্রমণে কোনো লক্ষণ প্রকাশ নাও পেতে পারে। ২০ শতাংশ রোগীর কিছু উপসর্গ দেখা যায়। আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। সংক্রমণের ৩ থেকে ১৪ দিন পরই লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। ভাইরাসটি শরীরের মধ্যে ১০ থেকে ১২ দিন সুপ্ত অবস্থায়ও থাকতে পারে।
এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে জ্বর, লাল র্যাশ বা ফুসকুড়ি, শরীর ও হাড়ের জোড়ায় ব্যথা, চোখের প্রদাহ (কনজাংটিভাইটিস) এবং চোখের পেছনে ব্যথা, মাংসপেশি ও মাথাব্যথা, ক্ষুধামন্দা ইত্যাদি দেখা দেয়। ডেঙ্গু জ্বরের মতো রক্তের প্ল্যাটিলেট কমে না, এমনকি রক্তক্ষরণের ঝুঁকিও নেই। সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো গর্ভাবস্থায় মা আক্রান্ত হলে প্রসব করা শিশুর ‘মাইক্রোসেফালি’ বা মাথার আকার ছোট হয়, ফলে মস্তিষ্ক অপুষ্ট ও অবিকশিত অবস্থায় থাকে। এ শিশুর বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও শারীরিক বৃদ্ধি বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
* রোগটি কি ঝুঁকিপূর্ণ
ডেঙ্গুর মতো এ রোগটি তীব্র ও প্রাণঘাতী নয়। এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে মৃত্যুর ঝুঁকি একেবারেই নেই।
* বেশি ঝুঁকিতে কারা থাকেন
জিকা অন্য ভাইরাসের মতো তেমন মারাত্মক নয়। তবে গর্ভাবস্থায় আক্রান্ত হলে মায়ের কাছ থেকে গর্ভস্থ শিশুর শরীরে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে।
* কীভাবে রোগ নির্ণয় করা যায়
লক্ষণ, ভ্রমণের ইতিহাস এবং ল্যাব পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে রোগ নির্ণয় করা হয়। রক্ত এবং প্রস্রাব পরীক্ষা করে সরাসরি ভাইরাস শনাক্ত করা যায়। গর্ভবতীদের ভ্রূণের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য আল্ট্রাসাউন্ড এবং অ্যামনিওসেন্টেসিস করা হয়।
* চিকিৎসা
নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই; লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৫ থেকে ১০ দিনের মধ্যে রোগী এমনিতেই ভালো হয়। পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম গ্রহণ, জ্বরের জন্য প্যারাসিটামলের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে পানি ও তরল খাবার খেতে হবে। গর্ভবতী মায়ের প্রতি বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। পরীক্ষা-নীরিক্ষার মাধ্যমে গর্ভস্থ্য সন্তানের মাথার অবস্থা জানা সম্ভব এবং বাচ্চা সংকটাপন্ন হলে মহিলা ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞের মতামত নিতে হবে।
* প্রতিকার ও প্রতিরোধ
এ ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক টিকা তৈরি হয়নি। প্রতিরোধের মূলমন্ত্রই হলো এডিস মশার বিস্তার রোধ এবং নিয়ন্ত্রণ। মশা নিধন করার ব্যবস্থা করতে হবে।
বিদেশে থেকে যারা বাংলাদেশে এসেছেন, তাদের দিকে নজর রাখতে হবে। বিশেষ করে যে সব দেশ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের কেউ আক্রান্ত হলে সেই অবস্থায় ভ্রমণ না করাই ভালো। জিকা কোনো জটিল রোগ নয়। এ রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি একেবারেই নেই। আক্রান্তদের পরবর্তিতে কোনো ক্ষতিকর প্রভাবও পাওয়া যায় না, যা ডেঙ্গু বা চিকনগুনিয়ার বেলায় হতে পারে। এমনকি একবার আক্রান্ত হলে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও নেই। তাই তেমন কোনো অ্যান্টি ভাইরাল ওষুধ বা টিকাও আবিষ্কার হয়নি।
তথ্য উপাত্ত সংগ্রহে ও সম্পাদনা : জ ই বুলবুল।